আর্থ্রাইটিস শব্দটির সঙ্গে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। এ ধরনের রোগের কারণ ও করণীয় সম্পর্কে আমরা অনেকেই তেমন কিছু জানি না। আর্থ্রাইটিস হচ্ছে হাড় অথবা হাড়ের জোড়ার প্রদাহ। বাংলায় এটিকেই বলা হয় বাত।

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. রফিক আহমেদ।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস: এটি এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী বাত ব্যথা। এটিকে বলা হয় অটো-ইমিউন ডিজিস। এ ধরনের রোগে আপনার দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আপনাকে প্রতিরক্ষা করার পরিবর্তে আপনার দেহের কোনো একটি অঙ্গ অথবা জয়েন্টের বিরুদ্ধে কাজ করে। আর ওই জয়েন্টে প্রদাহ হওয়ার ফলে অনুভব হয় প্রচণ্ড ব্যথা। কর্মক্ষম দেহ কলার ক্ষতিজনিত অস্বস্তিকর অনুভূতিকে ব্যথা বলা হয়।

একটি কারণ জানলাম, অটো-ইমিউন ডিজিস। এছাড়া কোনো কারণে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়লে এ রোগ হয় বলে অনেক বিজ্ঞানীদের ধারণা।

রিউমাটয়েড হ্যান্ড : এ আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হলে হাতের আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যাবে। হাতের আঙুলগুলো বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে থাকে।

সোয়াননেক ডিফর্মিটি : হাতের আঙুল বাঁকা হয়ে রাজহাঁসের গলার মতো হয়। বাটন হোল ডিফর্মিটি সুঁচ দিয়ে কাঁথা সেলাই করতে গেলে তরজনী আঙুল যে রূপ ধারণ করে তেমন হয়।

জেড ডিফমিটি : হাতের আঙুল ইংরেজি বড় হাতের অক্ষর জেডের আকার ধারণ করে-আঙুলের মাংস দুর্বল হয়ে পড়ে। এই তিনটিকে একত্রে বলা হয় রিডমাটয়েড হ্যান্ড বা হাত।

অস্টিও আর্থ্রাইটিস : আমাদের দেহের যে কোনো জয়েন্টের দুটি হাড়ের মাঝখানে তরুণাস্থি থাকে, যার ফলে আমরা খুব সহজেই নড়াচড়া ও হাঁটাচলা করতে পারি। অস্টিও আর্থ্রাইটিসে তরুণাস্থি ক্ষয় হয়ে যাওয়ায় প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। শরীরের যে কোনো হাড়ের জয়েন্টে এ রোগ হতে পারে, তবে ভার বহনকারী জয়েন্টে হওয়ার আশংকা বেশি।

আর্থ্রাইটিস কেন হয়

এটির অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয় বয়োবৃদ্ধি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তরুণাস্থিতে পানির পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং প্রোটিনের পরিমাণ কমতে থাকে। সেজন্য তরুণাস্থিও ক্ষয় হতে থাকে। শরীরের অতিরিক্ত ওজনও একটি কারণ হতে পারে। ওজন বেশি থাকলে বিভিন্ন জয়েন্টের ওপর বেশি চাপ পড়ার কারণে এ রোগ হতে পারে। আবার জন্মসূত্রে কারও কারও এ রোগ হতে পারে।

স্পনডিলাইটিস : আমাদের মেরুদণ্ড অনেক ছোট ছোট কশেরুকা (ভার্টিব্রা) দ্বারা গঠিত। স্পনডিলাইটিস হল মেরুদণ্ডের কশেরুকার প্রদাহ।

এ রোগের উপসর্গ হল ঘাড়ে, কাঁধে, পিঠে, কোমরে, বা মাজায় অসহ্য ব্যথা করা। ঘাড় ঘোরাতে শরীর বাঁকাতে এবং হাঁটাচলা করতে প্রচণ্ড অসুবিধা হতে পারে।

এছাড়া হালকা জ্বর, ক্ষুধামন্দা এবং ওজন হ্রাস পাওয়া হচ্ছে এ রোগের উপসর্গ।

এ রোগ যাদের হওয়ার আশংকা বেশি : এ রোগ সাধারণত ত্রিশ বছরের পরে হয়। যারা অনেকক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে কাজ করেন এবং অতিরিক্ত টেনশন যাদের নিত্যসঙ্গী তাদের এ রোগ হওয়ার আশংকা বেশি। এ রোগ বংশগত কারণেও হতে পারে।

গাউট-বা গাউটি আর্থ্রাইটিস : গাউট-অ্যাকুট হঠাৎ করে তীব্র ব্যথা শুরু হল- পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে। ফুলে গেল, লাল হয়ে গেল। ব্যথার তীব্রতা সাধারণত শেষ রাতে অথবা সকালে বেশি হয়। ব্যথার তীব্রতায় বা যন্ত্রণায় ঘুম ভেঙে যায়। ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি অল্প অল্প ব্যথা থেকে পরে তীব্র ব্যথা হতে পারে। অন্যান্য ছোট ছোট হাতের গিরা, পায়ের গিরা বা জয়েন্ট ফুলে গিয়ে যন্ত্রণা শুরু হয়। রোগের বর্ণনা থেকেই রোগ নির্ণয় করা যায়। খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয় না।

বংশগত কারণে গাউট হতে পারে। আবার অন্য কারণ যেমন-যারা অতিরিক্ত মদ্য পান করে। এছাড়া যেসব খাবারে পিউরিন বেশি থাকে সেসব খাবার বেশি খেলে গাউট হতে পারে। কিডনি বিকল রোগ, ডাইউরেটিক জাতীয় ওষুধ সেবন, টিবি রোগের ওষুধ সেবন এবং আরও অন্য রোগের কারণেও গাউট হতে পারে।

পুরুষদের ক্ষেত্রে ৪০ বছরের পরে এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৬৫ বছর বয়সের পরে গাউটে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বেশি থাকে।

গাউটে আক্রান্ত রোগীদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন- লাল মাংস-গরু, খাসি, মহিষ, ভেড়া, হরিণের মাংস না খাওয়া, ফুল কপি, বাঁধা কপি, ঘি, মাখন চর্বিযুক্ত খাবার না খাওয়া। গাজর, মটরশুঁটি, শিম, বরবটি, কলিজা, মগজ, কই মাছ, ইলিশ মাছ, গুঁড়া মাছ, পুঁইশাক, পালং শাক ইত্যাদি খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। যাদের বংশে আর্থ্রাইটিসের রোগী আছে তাদের ওপরের খাবার কম খাওয়া উচিত। অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাবার না খাওয়া উত্তম।

শরীর ব্যথা, বাতের ব্যথা, অনেকেই না জেনে, না বুঝে ওষুধের দোকানদারের কাছ থেকে বেদনানাশক ওষুধ কিনে খাচ্ছেন মোয়া-মুড়কির মতো। এ ওষুধ ২-৪-১০ দিন খাওয়া যেতে পারে। তাই বলে কোনো অবস্থাতেই মাসের পর মাস খাওয়া যাবে না। দীর্ঘমেয়াদি বেদনানাশক ওষুধ সেবনে কিডনি বিকল রোগ হয়। উচ্চ রক্তচাপের জন্ম হয়। গ্যাস্ট্রিক আলসারসহ বহুবিধ সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। অনেকে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সেবন করেন। ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত না খাওয়া উচিত।

বেদনানাশক ওষুধ সেবনই আর্থ্রাইটিস চিকিৎসার মূল কথা নয়। অনেক সময় অর্থপেডিক (হাড় ও জোড়া রোগ বিশেষজ্ঞ) সার্জন, নিউরোমেডিসিন ও নিউরোসার্জনের পরামর্শের প্রয়োজন হয়। প্রায় প্রতিটি মেডিকেল কলেজেই ফিজিওথেরাপি সেন্টার, ক্লিনিকগুলোতেও ফিজিওথেরাপি বিভাগ রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন রোগের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকার ‘রে’-যেটিকে সাধারণ জনগণ বলেন সেঁক দেয়া হয়।

সর্বোপরি আছে এক এক অঙ্গের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের ব্যায়াম। আপনার যদি কোমর ব্যথা হয় তার জন্য এক ধরনের ব্যায়াম, যদি ঘাড় ব্যথা হয় তার জন্য এক ধরনের ব্যায়াম, যা কিনা রোগের ধরন ও প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে দেয়া হয়। আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় ব্যায়ামের গুরুত্ব অপরিহার্য। আর্থ্রাইটিস যে কারণের জন্য হয়েছে সে কারণকে রোগ নির্ণয় পূর্বক চিকিৎসা করা হলে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। চিকিৎসার পূর্বশর্ত রোগ নির্ণয় করা, রোগ নির্ণয়ের পূর্ব শর্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা।

দৈনন্দিন জীবনে যে জিনিসগুলো মেনে চলবেন কীভাবে বসে কাজ করবেন? কীভাবে গাড়ি চালাবেন? কীভাবে বালিশে শোবেন? ঘরবাড়ির কাজে করণীয়, ভারি জিনিস তোলার সময় সতর্কতা : সেলুনে ম্যাসাজ একেবারেই নিষেধ। হাইহিল বিপত্তি, জুতোর ফিতে বাঁধবেন কীভাবে? শিশুকে কোলে নেবেন কীভাবে, বিছানার তোশক কেমন হওয়া উচিত? এগুলো সবই প্রাকটিক্যাল বিষয়, যার সঠিক সমাধান দিতে পারেন- একজন ফিজিওথেরাপিস্ট। হালকা ব্যায়াম করুন, ওজন কমান, সুস্থ থাকুন।

আর্থ্রাইটিস নিয়ে সুস্থ থাকার কয়েকটি উপায়

* যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

* আপনার রোগের ধরন এবং নিরাময় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন।

* বেশি ব্যথার ওষুধ ব্যবহার না করে জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করুন।

* মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকুন।

* অতিরিক্ত বিশ্রামের পরিবর্তে কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করুন।

* ব্যায়াম করাকে একটি নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করুন।

* অবসর সময় প্রিয়জনের সঙ্গে অতিবাহিত করুন।

যে কয়েকটি ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন

* টেবিলে বসে ঝুঁকে পড়াশোনা করবেন না।

* বেশি নরম গদি-তোশক এবং উঁচু বালিশ ব্যবহার করবেন না।

* দেহের মেদ কমান-পুষ্টিকর খাবার খান।

* টেনশন কমান।

* প্রতিদিনই হালকা কিছু ব্যায়াম করুন।

* নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করুন।

* শীতকালে ঠাণ্ডায় এবং বর্ষায় স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় বয়স্করা সাবধানে থাকবেন।

* চিকিৎসকের পরামর্শ মতো দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং ওষুধ সেবন করবেন।

* স্বাস্থ্যবান সুখী মানুষ কখনও অতীত বা ভবিষ্যতে বসবাস করে না। সে সব সময়ই বাস করে বর্তমানে।

* প্রার্থনা রোগের উপসর্গ কমায় এবং সুস্থতার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।

* রাগ-ক্ষোভ, ঈর্ষা, সন্দেহ দুরারোগ্য ব্যাধি সৃষ্টি করে। এগুলো ঝেরে ফেলুন, আপনার সুস্থ থাকার সার্মথ্য বেড়ে যাবে।

উপদেশ

সম্পূর্ণ বিশ্রাম ৩-৭ দিন। মালিশ নিষেধ। এক বালিশ ব্যবহার করবেন। শক্ত ও সমান বিছানায় ঘুমাবেন। ফোম জাজিম ব্যবহার। সামনে ঝোঁকা, ভারি কাজ, গরম সেঁক নিষেধ। নামাজ চেয়ার টেবিলে পড়বেন। উঁচু কমড ব্যবহার করবেন। নিচে বসা নিষেধ, সোজা হয়ে বসবেন। মগে গোসল করবেন না, শাওয়ার ব্যবহার করবেন, কোমরে বেল্ট (করসেট) পরবেন। যার ঘাড়ে সমস্যা তারা কলার ব্যবহার করবেন।

যে কোনো অসুস্থতাই আমাদের মনে করিয়ে দেয় সুস্থ থাকাটা কত জরুরি। যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের সুস্থতার ওপর নির্ভর করে আমাদের ভালো থাকা। এদের কোনটিতে একটু সমস্যা হলেই ঘটে বিপত্তি। জীবনটাই হয়ে উঠে দুর্বিসহ। আর যদি তা হয় ব্যথাজনিত অসুস্থতা তবে তা আমাদের ফেলে দেয় রীতিমতো দুর্ভাবনায়। সমস্যা যাই আসুক চেষ্টা আর সঠিক চিকিৎসা জানা থাকলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় খুব সহজেই।